ঐতিহাসিক “ঈদে গাদীর” ইসলামের পরিপূর্ণতার দিন।
আজ ঐতিহাসিক গাদির‑দিবস উপলক্ষে সমস্ত আশিকে রাসুল সাঃ ও আহলে বায়াত প্রেমিকদের প্রতি অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইল।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

যথাযোগ্য প্রশংসা কেবল তারই, যিনি আপন কুদরতের দ্বারা সৃষ্টি জগতকে পরিচালিত করেন এবং যিনি জীবন ও মৃত্যুর মালিক। দরুদ ও সালাম রাসূল (সাঃ) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি, যাঁরা নিজেদের সকল কিছুকে উৎসর্গ করে মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রচেষ্টা করেছেন। সালাম ও দরুদ ইমাম মাহদী (আঃ)-এর প্রতি, যিনি আজও মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যস্ত। আল্লাহ তাঁর আগমনকে দ্রুত ত্বরান্বিত করুন।

আজ ১৮ ই জিলহজ্ব ইসলামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় মহাখুশির দিন। দশম হিজরির এই দিনে বিদায় হজ্ব থেকে ফেরার পথে, সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত নাজেল হওয়ার পর রাসুলে খোদা (সা.) গাদিরে খুম নামক স্থানে এক লাখ বিশ হাজারেরও বেশি হজ্ব ফেরৎ হাজী সাহাবাগনের সম্মুখে মাওলা আলীকে (আঃ)-কে আল্লাহর খলিফা ও মুমিন উম্মাহর ইমাম হিসাবে নিযুক্ত করে নিজের স্থলাভিষিক্ত বলে ঘোষণা করেছিলেন।এই ঘোষণার সাথে সাথেই মহান আল্লাহ তায়ালা ইসলামকে তাঁর মনোনীত পরিপূর্ণ চুরান্ত ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দান করেন। এই দিনটি ঐতিহাসিক গাদীর দিবস বা ঈদে গাদীর হিসেবে খ্যাত।এই দিনটি মুমিন উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন।তাই সকল আহলে বায়াত প্রেমিক মুমিন মুসলমানদের জন্য এই দিন মহা ঈদ হিসাবে গণ্য হয়। কারণ ঈদ মানে হলো আনন্দ ও উৎসব। তাই আহলে বায়াতের গোলামরা মাওলার অভিষেক দিনটি মহা ঈদ হিসাবে পালন করে থাকে। সাওম ও এতেকাফের কামিয়াবীর কারনে ঈদুল ফিতরের আনন্দ, আর ত্যাগ ও তাকওয়ায় কামিয়াবীর কারনে ঈদুল আযহার আনন্দ; আর ঈদে গাদিরে খুমের আনন্দ দ্বীন ইসলামের পূর্ণতার কারনে।এমন কোনো নবী মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হননি যিনি এ দিবসটিকে ( ১৮ যিল হজ্জ ) ঈদ হিসেবে উদযাপন করেননি এবং এ দিবসের মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন না। আসমানে এ দিবসের নাম প্রতিশ্রুত প্রতিজ্ঞার দিবস ( রোয‑ই আহদ‑ই মওঊদ ) এবং জমিনে এর নাম রোয‑ই মীসাক ( প্রতিশ্রুতির দিবস)।

আজ ঐতিহাসিক গাদির‑দিবস উপলক্ষে সমস্ত আশিকে রাসুল সাঃ ও আহলে বায়াত প্রেমিকদের প্রতি অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইল।

ইমাম জাফর আস‑সাদিক (আ.)-বলেছেনঃ মুসলমানদের একটি ঈদ আছে যার মর্যাদা অন্য সব ঈদের চেয়েও বেশি।আর তা হচ্ছে ঐ দিন যে দিন মহানবী (সা) হযরত আমিরুল মু‘মিনিন আলী (আ)-কে খিলাফতে অধিষ্ঠিত করেন এবং বলেন, আমি যার মওলা ও নেতা আলী তাঁর মওলা ও নেতা ( মাফাতীহুল জিনান, পৃঃ ৫০২)।এ দিবসের তাৎপর্য ও বার্তা সম্পর্কিত আজকের এই বিশেষ আলোচনা।সঙ্গত কারণে আর্টিকেলটি কিছুটা দীর্ঘ হয়ে যাওয়াতে দুঃখিত । অনুরোধ রইল যে,ধৈর্য সহকারে পড়ুন- অজানা অনেক কিছুই জানবেন।

দশম হিজরীতে মহানবী(সা.) ২৪ অথবা ২৫ শে জ্বিলকাদ শনিবার হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে পায়ে হেঁটে মক্কার পথে রওনা হন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর আহবানে সাড়া দিয়ে লাখো মুসলমান মক্কায় হজ্বব্রত পালন করতে যান। এটাই ছিল আল্লাহর রাসুলের (সাঃ)-এর প্রথম ও সর্বশেষ হজ্ব।বিদায় হজ্ব নামে যা আজও পরিচিত। ওই হজ্বের কিছু দিন পরই হযরত মুহাম্মদ (সা.) হায়াতে জিন্দেগী থেকে পর্দা করেন। মক্কার পথে রাসূলে খোদা (সা.)-র সফরসঙ্গী হওয়ার জন্য বিপুল সংখ্যক মুসলমান মদিনায় জড়ো হন। রাসূলের এ হজ্বকে নানা নামে অভিহিত করা হয়। এর মধ্যে হুজ্জাতুল বিদা, হুজ্জাতুল ইসলাম, হুজ্জাতুল বালাগ, হুজ্জাতুল কামাল ও হুজ্জাতুত তামাম অন্যতম।

রাসুলে খোদা (সা.) তাঁর সমগ্র জীবনে (আ)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসাবে প্রস্তুত করার কাজে রত ছিলেন। যদিও রাসূল (সা.) তাঁর নবুওয়াতী জীবনের বিভিন্ন সময় মুসলমানদের বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের সামনে মওলা আলীর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেছেন, এমনকি তাঁর বংশের বার জন ইমাম ও প্রতিনিধির নামও অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুসলমানদের বিশাল কোন সমাবেশে এ ঘোষণা তিনি ইতোপূর্বে দেননি।যেহেতু স্থলাভিষিক্তের বিষয়টি নবুওয়াতী মিশনের পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য ছিল সেহেতু তিনি চেয়েছেন ইসলামী ভূখণ্ডের সকল প্রান্ত থেকে মুসলমানরা এ সমাবেশে আসুক। মহানবী (সা.) এ উদ্দেশ্যে এ হজ্বে আসার পূর্বেই সকলকে এতে যোগদান করার জন্য বিভিন্ন স্থানে বার্তা পাঠিয়েছিলেন।

ইতোমধ্যে হজ্বের সময় ঘনিয়ে এল।রাসুলে খোদা (সাঃ) মুসলমানদেরকে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র হজ্ব পালন করলেন।রাসুলে খোদা (সাঃ) যখন আরাফার মহাসমাবেশে বক্তব্য দানের জন্য উঠলেন তখন হযরত জিব্রাইল (আ.) অবতীর্ণ হয়ে হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ঘোষণার নির্দেশ নিয়ে আসলেন। কিন্তু আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিস্থিতি বিবেচনা করে তা ঘোষণা হতে বিরত থাকলেন। তিনি এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, কুরাইশ ও অন্য আরবরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে-তিনিও আরব গোত্রপতিদের মত (স্বীয় পুত্রের অনুপস্থিতিতে) নিজের চাচাত ভাইকে স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি হিসাবে ঘোষণা করেছেন। তাই তিনি যথাযথ সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

১৮ই জ্বিলহজ্ব বৃহস্পতিবার হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলে সকল হাজী স্ব স্ব দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য যাত্রা শুরু করলেন। নবীজী (সাঃ) এবার সোয়া লক্ষ হজ্ব ফেরৎ মুসলমানদের সঙ্গে মাতৃভূমি মক্কাকে বিদায় জানালেন,চলছেন প্রিয় মদীনার পথে ।আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-কে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছিল।ব্যাপারটা বিশিষ্ট সকল সাহাবীর ব্যাপারটা পরিলক্ষিত হলে সবার মনেই এক অজানা আশঙ্কা দেখা দিল। কাফেলা জুহফা‘র কাছাকাছি গাদীরে খুম নামক স্থানে পৌঁছান, যেখান থেকে ইয়েমেন, সিরিয়া ও মদীনার পথ পৃথক হয়ে যায়। ঠিক তখনি রাসুলে খোদা (সাঃ)-এর কাছে ওহি নাজিল হয়। জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ-

يَا أَيُّهَا الرَّ‌سُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّ‌بِّكَ ۖ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِ‌سَالَتَهُ

“ইয়া আইয়্যুহার রাসুল বাল্লিগ মা- উনযিলা ইলাইকা মির রাব্বিকা; ওয়া ইললাম তাফ’আল ফামা বাল্লাগতা রিসালাতাহু; ওয়াল্লাহু ইয়াসিমুকা মিনাননাসি; ইন্নাল্লাহা লা ইয়াহদিল কাওমাল কাফেরীন।”

অর্থাৎ, “হে রসূল, পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।”-(সূরা মায়েদা: আয়াত ৬৭)।

উক্ত আয়াতে করিমটি কোরানের শেষ আয়াতের আগের আয়াত।উক্ত আয়াতে করিমে বলা এমন কি আদেশঃ

আল্লাহপাক নবীকরিম (সাঃ) কে দিয়েছেন যা এখনো পৌঁছানো হয় নি❓
এবং তা শীঘ্রই পৌঁছিয়ে দিতে পুনঃনির্দেশ দেওয়া হচ্ছে❓
এবং তা পৌঁছানো ব্যতীত রেছালত পৌছানো সম্পন্ন হল না বলে স্বয়ং আল্লাহ্‌পাক ঘোষণা করছেন❓

উক্ত আদেশ পৌঁছানোর ব্যাপারে এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে।সুতরাং আর দেরী করা যাবে না,কারণ শীঘ্রই আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় হাবিব(সাঃ) কে তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে আনবেন । হযরত (সাঃ)-এর উপর দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে পবিত্র কোরাআন মাজীদ নাযিল হয়ে আসছে।নবুয়ত ও রেছালতের বিভিন্ন নির্দেশ যথাসময়ে তিনি উম্মতের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।কোরান অবতীর্ণ ও প্রায় শেষ।আর মাত্র একটি আয়াত নাযিল হতে বাকি ।বিদায়হজ্বে সকলের কাছ থেকে বিদায়ও নেওয়া হয়েছে।নবীজী (সাঃ) ‑এর শেষ সময় ‚আর মাত্র ৮০ বা ৮৪ দিন বাকী।এখন চিন্তার করার বিষয় হচ্ছে,কি এমন নির্দেশ আল্লাহপাক দিয়েছেন,যা এখানো পৌঁছানো হয়নি।সত্যিই ভাববার বিষয়! এ ঐতিহাসিক ঘটনার ৮০ কিম্বা ৮৪ দিন পর প্রিয়নবী (সাঃ) আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান ।

মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেনঃ

“এবং তোমার রব যা ইচ্ছা তা সৃষ্টি করেন, এবং যাকে ইচ্ছা তাকে মনোনীত করেন। লোকেদের মনোনয়ন করার কোন অধিকার নেই।”-সূরাঃ কাসাস, আয়াত: ৬৮।
এই ইমামত হচ্ছে নবুওতেরই ধারাবাহিকতা।ইসলামে ঐশী ইমামত বা খোদায়ী নেতৃত্ব ঠিক করে দেন মহান আল্লাহ। আর সেটা বংশ পরম্পরায়ও চলতে পারে। যেমন, নবী হয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ.)‘র বংশধরগণ এবং হযরত দাউদ (আ.)‘র পুত্র সুলায়মান ও হযরত মুসা (আ.)‘র ভাই হারুন (আ.)।ইমামত বা নবুওতের মত ঐশী বা খোদায়ী পদগুলোতে কারা আসীন হবেন মানুষ তা ঠিক করার অধিকার রাখে না। কারণ, মানুষের মনোনয়ন বা নির্বাচন ভুলও হতে পারে। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই তা ঠিক করে দেন। বিশ্বনবী (সা.) বিভিন্ন সময় আলী(আ.) কে নিজ খলিফা হিসেবে নিযুক্ত করার কথা ঘোষণা করেছেন।সুতরাং এটা খুবই পরিস্কার যে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেবার জন্য নেত্রবৃন্দ স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এখানে মানবের কোনো হাত নাই।


ইমাম জাফর আস‑সাদিক (আ.)-হতে বর্ণিতঃ

إِنَّ اَللَّهَ تَبَارَكَ وَ تَعَالَى اِتَّخَذَ إِبْرَاهِيمَ‏ عَبْداً قَبْلَ أَنْ يَتَّخِذَهُ نَبِيّاً وَ
إِنَّ اَللَّهَ اِتَّخَذَهُ نَبِيّاً قَبْلَ أَنْ يَتَّخِذَهُ رَسُولاً وَ إِنَّ اَللَّهَ اِتَّخَذَهُ رَسُولاً قَبْلَ أَنْ يَتَّخِذَهُ خَلِيلاً وَ إِنَّ اَللَّهَ اِتَّخَذَهُ خَلِيلاً قَبْلَ أَنْ يَجْعَلَهُ إِمَاماً فَلَمَّا جَمَعَ لَهُ‏ اَلْأَشْيَاءَ قَالَ‏ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَاماً قَالَ فَمِنْ عِظَمِهَا فِي عَيْنِ‏ إِبْرَاهِيمَ‏ قَالَ‏ وَ مِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لاَ يَنَالُ عَهْدِي اَلظَّالِمِينَ‏ قَالَ لاَ يَكُونُ اَلسَّفِيهُ إِمَامَ اَلتَّقِيِ‏. اصول کافی : ج، ص

“যায়েদ শাহাম বর্ণনা করেছেন আমি ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) এর নিকট থেকে শুনেছি, তিনি বলেনঃ নিঃশন্দেহে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহীমকে নবী বানানোর পূর্বে নিজের বান্দ (দাস) বানিয়েছেন, আর তাঁকে রেসালতের পদে অধিষ্ঠত করার পূর্বে তাঁকে নবুওয়তের পদে ভূষিত করেছেন, তাঁকে খলীল বানানোর পূর্বে তাঁকে রেসালতের পদমর্যদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁকে ইমামতের পদ মর্যাদায় ভূষিত করার পূর্বে খলীল বানিয়েছেন, আর যখন সমস্ত পদে উত্তীর্ণ হলেন, আল্লাহ তায়ালা বললেন: “আমি তোমাকে জনগণের ইমাম বানালাম” (হযরত ইব্রাহীম আঃ) বললেনে: আমার বংশধরের মধ্যেও? (আল্লাহ তায়ালা) বললেন : আমার এই পদ অত্যাচারিদের নিকট পৌঁছাবে না। ইমাম বললেন: বিবেবহীন ও পাপি ব্যক্তি মুত্তাকির নেতা বা ইমাম হতে পারে না”।(সূত্র : উসূলে কাফী : খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪১)


যাইহোক ফিরে আসি মূল আলোচনায়,রাসূলে খোদা (সা.) আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার পরঅনতিবিলম্বে সকলকে যাত্রা বিরতি করার নির্দেশ দিলেন। তিনি নিজের জন্য তাঁবু খাটালেন এবং অন্যদেরকে তাঁবু স্থাপনের আদেশ দিলেন। চলার পথে যারা কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলেন তারা পেছনে ফিরে আসেন। আর যারা পেছনে ছিলেন তারা এগিয়ে এসে ওই স্থানে থেমে যান। রৌদ্রস্নাত উত্তপ্ত মরু হাওয়ায় সবাই তখন ক্লান্ত অবসন্ন । তারপরও সবাই খুবই মনোযোগ সহকারে অপেক্ষা করতে লাগলেন রাসূলের বক্তব্য শুনার জন্য। তারা বুঝতে পারলেন, রাসূল (সা.) মুসলমানদের জন্যে নতুন কোনো বিধান বা দিক নির্দেশনা দেবেন ।গাদীরের ওই সমাবেশে এক লাখ বিশ হাজারেরও বেশি সাহাবি ও হজযাত্রী উপস্থিত ছিলেন।

ওই স্থানে পাঁচটি পুরনো গাছ ছিল। রাসূলের নির্দেশে গাছের নিচের জায়গাটুকু পরিস্কার করা হলো। এরপর সাহাবিরা সেখানে চাদোয়া টানিয়ে দিলেন। জোহরের আজান দেয়ার পর মহানবী সবাইকে নিয়ে সেখানে নামাজ আদায় করলেন। নামাযান্তে উটের ওপর বসার আসনগুলো দিয়ে উঁচু করে এক মঞ্চ তৈরি করা হল।এরপর শুষ্ক মরুর বুকে প্রচণ্ড গরমের মাঝে উটের আসন দিয়ে তৈরী বিশেষ মেম্বরে দাঁড়িয়ে তিনি ঐতিহাসিক এক খোতবা দিলেন।

রাসুলে খোদা (সাঃ) বললেনঃ 
“সমস্ত প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুর আলামিনের। আমরা তারই সাহায্য চাই ও তার ওপরই ঈমান এনেছি। তার ওপরই আমাদের ভরসা। কেবল তিনিই বিভ্রান্তদেরকে সৎ পথে পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখেন। আর আল্লাহ যাকে দিকনির্দেশনা দেন, তিনি যেন বিভ্রান্তকারীতে পরিণত না হন। আমি এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি ছাড়া আর কেউ উপাসনার যোগ্য নয় এবং মুহাম্মদ হচ্ছে তার বান্দা ও প্রতিনিধি। দয়াময় ও মহাজ্ঞানী আল্লাহই আমাকে এ সংবাদ দিয়েছেন যে, আমার ইহকালীন জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে, অচিরেই আমার জীবনের অবসান ঘটবে, মহান সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে এ জগত ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে। আমার ও আপনাদের ওপর যেসব বিষয় অর্পিত হয়েছে, সেসব বিষয়ে আমরা সবাই দায়িত্বশীল।আমি কি আমার উপর অর্পিত রেসালতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি ?

এ লক্ষাধিক সাহাবা উচ্চস্বরে বলে ওঠেনঃ
 “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, বার্তা পৌঁছে দেয়া, কল্যাণকামিতা তথা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আপনি কোনো ধরনের অবহেলা করেননি। আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।”

এ সময় রাসুলে খোদা (সাঃ) বলেনঃ “আপনারা কি এ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে-আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল এবং বেহেশত, দোজখ, মৃত্যু ও কিয়ামতের বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়া, আল্লাহ মৃতদেরকে পুণরায় জীবিত করবেন?”

উত্তরে লক্ষাধিক সাহাবা সমস্বরে বলেনঃ 
“ইয়া রাসূলাল্লাহ,হ্যা আমরা এ সত্যের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছি।”

এরপর রাসুলে খোদা (সাঃ)আল্লাহর উদ্দেশে বলেনঃ
 “হে আল্লাহ আপনিতো দেখতেই পাচ্ছেন।”

এরপর রাসুলে খোদা (সাঃ) বলেনঃ
“আমি আপনাদের আগে হাউজে কাউসারে প্রবেশ করবো। এরপর আপনারা সেখানে প্রবেশ করবেন এবং আমার পাশে অবস্থান নেবেন। সানা ও বসরার মধ্যে যে দূরত্ব,আমার হাউজে কাউসের প্রশস্ত হবে সে পরিমাণ। সেখানে থাকবে তারকারাজি এবং রুপার পাত্র।”

এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার উদ্দেশে বলেনঃ
“মূল্যবান ও সম্মানিত যে দুটি জিনিস আপনাদের কাছে রেখে যাচ্ছি, আপনারা কীভাবে তা মেনে চলেন, তা আমি দেখতে চাই।”

এ সময় সবাই সমস্বরে বলে ওঠেনঃ “হে রাসূলুল্লাহ, ওই দু‘টি মূল্যবান ও সম্মানিত জিনিস কী”❓

রাসূল (সা.) বললেনঃ

“ইয়া আয়্যুহান্নাছু ইন্নি তারাকতু ফি কুম মা ইন্‌ আখাজতুম লান তাদেল্লু বায়দি আউয়ালুহা কেতাবাল্লাহে ওয়া এতরাতি আহলে বায়াতি।”

অর্থাৎ, “ হে মানবমণ্ডলী আমি তোমাদের নিকট যাহা রাখিয়া যাইতেছি তাহা যদি আঁকড়িয়ে থাক তবে পথভ্রষ্ট হইবে না। প্রথমটি আল্লাহর কেতাব, দ্বিতীয়টি আমার আহলে বায়াত।”

গ্রন্থসূত্রঃ- সহিহ মুসলিম, ৭ম খণ্ড, পৃ:-১২২, দারুল যিল, বৈরুত; সহিহ তিরমিযি, ৫ম খণ্ড, পৃ:-৬৬৩, বৈরুত; মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড, পৃ:-১৪, বৈরুত; কানযুল উম্মাল, ১ম খণ্ড, পৃ:-১৮৭; মুসতাদরাকে হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃ:-১৪৮, বৈরুত।মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৪ ও ১৮ (আবু সাঈদ খুদরী সূত্রে বর্ণিত); সুনানে তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩২৯, হাদীস নং ৮৩৭৬; মুসতাদরাক, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০৯ ও ১৪৮, ফাজায়িলুস সাহাবা, পৃ. ৩৭৪, মুজামুল আওসাত, তাবরানী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৭৪; মুজামুল কাবীর, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৬৬ ও ১৬৯।


অতঃপর বললেনঃ আমি কি মুমিনদের ওপর তাদের নিজেদের থেকেও অগ্রাধিকার (শ্রেষ্ঠত্ত) রাখি না❓

সকলে উত্তর দিলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ ‘হ্যাঁ’ আপনি আমাদের নিজেদের জীবনের চাইতেও অতি আপন।’

তখন তিনি হযরত আলী (আ.)-এর হাত এতটা উঁচু করে ধরলেন যে, তাঁদের উভয়ের শুভ্র বগল দেখা যাচ্ছিল।

এরপর তিনি বললেনঃ-

“মান কুনতুম মাওলাহু ফাহাজা আলীউন মাওলাহু আল্লাহুম্মা ওয়ালে মান ওয়ালাহু, আদা মান আদাহু, অনসুর মান নাসারা, অখজুল মান খাজালা, ফাল ইয়াস হাদিল হাজেরুল খায়েরা।”

“আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা।” এই বাক্যটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। এরপর বললেন:- “হে আল্লাহ! তাকে তুমি ভালবাসত যে আলীকে ভালবাসে ও তুমি তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে;এবং যে তাকে সাহায্য করে, তুমিও তাকে সাহায্য কর, আর যে তাকে পরিত্যাগ করে, তুমিও তাকে পরিত্যাগ কর।”


হে লোকসকল! আপনারা অবশ্যই যারা উপস্থিত আছেন তারা এই বাণীটি অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দিবেন।রাসু্লে খোদার (সাঃ) এই ভাষণের পরপরই হযরত জিব্রাইল (আঃ) আবার অহী বা প্রত্যাদেশ বাণী নিয়ে এলেন।তখনই আল্লাহ পবিত্র কুরআন শরীফের শেষ আয়াত নাজিল করে কোরআন শরিফের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেনঃ

“আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও আমার নেয়ামত বা অবদানকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।”- সুরা — মাইদাহ / ৩ ।[আল কোরআন এর শেষ আয়াত]

উল্লেখ্য,আল্লাহ তায়ালা এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিলেন এবং অবশেষে কোরআন শরিফের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। অথচ মুসলিম জাতি আমরা জানিই না ঈদে গাদিরে খুম দিবস কি? যতদিন পর্যন্ত আমরা গাদীরে খুমে ফিরতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের কোন মুক্তি নেই। গাদীরে খুমে রাসূল পাক (সঃ) এর ঐতিহাসিক বাণী মোবারক যিনি হৃদয়ে ধারণ করে মেনে চলবেন, তিনিই মুমিন মুসলমান। আর গাদীরে খুম অস্বীকারকারী মোনাফেক হিসাবে চিহ্নিত। সে কখনো মুসলমান হতে পারে না।


রাসুলে খোদা (সাঃ) এই বাণী পেয়ে মহা-আনন্দিত হলেন এবং বললেনঃ -

“আল্লাহু আকবার,আল হামদুল্লিলাহা আলা আকমালে দ্বীনা,ওয়া এতমামেন নেয়ামতিন,ওয়া রেজা য়ে রাব্বি আলা-রেসালাতী ওয়া বেলায়াতি আলী ইবনে আবু তালেব।”

অর্থাৎ,মহান আল্লাহর শুকর করছি যে তিনি দ্বীনকে পরিপূর্ণ ও তাঁর নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন এবং মহান প্রভু আমার রেসালাতের বা নবুওতি দায়িত্বের ও আলীর বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন।


সুত্র:-হাকেম হাসকানী তার স্বীয় তফসীরে,হাফেজ আবু নাঈম ইসপাহানী’মা আনযাল মিনাল কোরান ফা আলীয়্যান গন্থে উল্লেখ।সূত্র গাদীর-এ-খুমের তাৎপর্য।মাওলানা আলী আক্কাস। রসুল(সাঃ) এর ওই ভাবের উপর আল্লাহর যে নির্দেশ হয়েছিল তার উপর টীকা করতে গিয়ে তফসীরে কাশশাফ লিখেছেন- হজ্বছে যাব তুম ফারেগ হো তব আলী কো মোকাররার কর দো।


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আল্লাহর রাসূল (স.) তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বলেছিলেনঃ “আমি কি তোমাদের ওপর তোমাদের নিজেদের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব রাখি না?” তখন উপস্থিত সব মুসলমান দাঁড়িয়ে রাসূল (স.) এর এ কথার প্রতি সম্মতি জানান। অতএব, বিষয়টি হতে স্পষ্ট হয় যে, এই হাদিসে ‘মাওলা’ বলতে মু’মিনদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাদের পূর্ণ কর্তৃত্বকে বোঝানো হয়েছে। অতএব, এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহর রাসূল (স.) যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন তা তিনি আলী(আ.) এর জন্যও তা নিশ্চিত করে যান। ”

এরপর আঁকা (সাঃ) হাত উত্তোলন করলেন এবং দোয়া করলেনঃ হে আল্লাহ্! যে আলীকে অলি মানে, তুমি তার অলি হয়ে যাও। আর যে আলীর প্রতি দুষমনি রাখে, তুমি তার দুষমন হয়ে যাও। যে আলীকে সাহায্য করে, তুমি তাকে সাহায্য করো। যে আলীকে মন্দ ভাবে তুমি তাকে লাঞ্ছিত করো। যে আলীকে ভালোবাসে, তুমিও তার প্রিয় হয়ে যাও। যে আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, তুমিও তার সাথে শত্রুতা পোষণ করো।”

উল্লেখ্য, নবীগণের দোয়া আল্লাহ্‌ পাক ফিরিয়ে দেন না। নবীগণের দোয়া মকবুল অর্থাৎ নিশ্চিত কবুল হয়। রাসূল (সাঃ) জানতেন, তাঁর বিদায়ের পর মওলা আলীর সাথে কী আচরণ করা হবে। তিনিও এও পরিষ্কার জানতেন, তাঁর বিদায়ের পর আহলে বাইত আতহারগণের সাথে কী আচরণ করা হবে। আর তাই তিনি বারবার আহলে বাইত এবং বিশেষ করে মওলা আলীর সাথে বুঝেশুনে আচরণ করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। মুস্তাদরাকে আলাস সাহিহাইনে ইমাম হাকিম নিশাপুরি রহঃ সহীহ সনদে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেনঃ “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর পাক (সাঃ) ইরশাদ করেন,কোনো ব্যক্তি যদি সম্মানিত রুকন এবং সম্মানিত মাক্বামের মধ্যবর্তী স্থানে সারিবদ্ধ হয়ে থাকে। অতঃপর নামায পড়ে এবং রোযা রাখে, কিন্তু এই অবস্থায় তার মৃত্যু হয় যে, সে আহলে বায়েতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। তাহলে সে অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (মুস্তাদরাকে হাকীমঃ ৪৭৬৬, যাখাইরুল উক্ববা লি-মুহিব্বে ত্ববারী ১/১৮, হাদিসের মান সহীহ)

রাসূল (সাঃ) তাঁর দোয়া শেষ করার পর মঞ্চ হতে নেমে আসলেন এবং একটি তাঁবুতে বসে নির্দেশ দিলেন যেন, আলী অপর এক তাঁবুতে বসে। অতঃপর বললেন, যেন সব সাহাবীগণ আমিরুল মুমিনীনকে অভিবাদনের জন্য আসেন ও বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের পদাসীনকে অভিবাদন জানান।রাসুলের আ. আদেশ অনুসারে নব নিযুক্ত নেতার নিকট আসিয়া সকলেই আনুগত্যের বায়াত গ্রহণ করেন। আবুবকর,উমর, ওসমান, তালহা ও যুবাইর সবার আগে এবং এরপর রাসূলের স্ত্রীগণসহ অন্যরা আলী (আ.)-কে অভিনন্দন জানান।উমর বলেছিলেনঃ

بخ بخ لک یا ابن أبی‌طالب أصبحت مولای و مولى کل مسلم‏

অর্থাৎ,অভিনন্দন, অভিনন্দন হে আবু তালিব নন্দন! আজ হতে আপনি আমার এবং সকল মোমিন‑মোমিনাদের মাওলা হলেন।


[সূত্রঃ — মুসনাদে হাম্বাল , খন্ড‑৪, পৃ-২৪ / তাফসিরে আল কাবীর, খন্ড‑১২, পৃ-৪৯ / কানজুল উম্মাল, খন্ড‑৬, পৃ-৩৯৭ / আর রিয়াযুন নাজরা, খন্ড‑২ ‚পৃ-১৬৯ / মুস্তাদারাকে হাকেম, খন্ড‑৩, পৃ-১০৯ / ইবনে কাছির দামাস্কী /আল‑বেদায়াহ ওয়ান নেহায়াহ/ বৈরুত আল‑ফিকর প্রকাশণী ১৪০৭ হিজরী]

বিশিষ্ট সুন্নি আলেম ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে জারির তাবারী, তাঁর “আল‑বেলায়াহ” গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেনঃ “সেদিন বাইআতকারী প্রথম ব্যক্তি হলেন হজরত উমর, তার পরে হজরত আবু বকর, হজরত উসমান, এবং হজরত তালহা ও হজরত যুবায়ের।“কিন্তু রাসূল পাক সঃ পর্দা নেওয়ার সাথে সাথে অধিকাংশ সাহাবী গাদীরে খুমের ওয়াদা ভুলে গেল এবং মরণ নেশায় মেতে উঠল। ক্ষমতার লোভ এবং গভীর ষড়যন্ত্র সবাইকে আকৃষ্ট করল। যার ফলশ্রুতিতে ১৮ই জ্বিলহজ্ব ১০ম হিজরী, রসুল সঃ কতৃক এই দিনে আলী (আঃ) এর বেলায়তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা; এর ২৫ বছর পর ঠিক এই দিনেই মদীনায় তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন।মাওলা আলী (আ.) প্রথম খলিফা থেকে চার নাম্বার খলিফা হয়ে গেল। আল্লাহ যাঁকে এ্যাতো সম্মানে ভূষিত করলেন , তিনি যে সবসময় সত্যের ওপরই অটল থাকবেন, তাতে আর সন্দেহ কী! কিন্তু কালের ঘোলাজলে বিচক্ষণ মাছ শিকারীরা তাঁর ওপর যেসব রাজনৈতিক কূটচাল চেলে সাময়িক স্বার্থ চরিতার্থ করেছিল,তাদের কৃতকর্ম আজ অপ উপসর্গযোগে কলঙ্কিত।দেখুন,আল্লাহর নির্দেশে আল্লাহর রাসুল মাওলা আলী (আঃ)-কে আল্লাহর খলিফা ও মুমিন উম্মাহর ইমাম হিসাবে নিযুক্ত করে নিজের স্থলাভিষিক্ত ঘোষনার পরও যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ অমান্য করে মাওলা আলী (আঃ)-কে অস্বীকার করলো,তারা তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাফের।কি,কোন ভুল বললাম ! কারণ পবিত্র কুরআন ও শরীয়ত তো কাফের বলে তাকে,যে আল্লাহ ও তার নির্দেশ অমান্যকারী।

“একজন বিশ্বাসী পুরষ অথবা একজন বিশ্বাসী নারীর অধিকার নেই , যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোন একটি বিষয় সিদ্বান্ত নিয়েছেন, (তখন) তাদের বিষয় অন্য কিছু পছন্দ করার , এবং যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করে নিঃসন্দেহে (সে) পথভ্রষ্ট হয়েছে সুস্পষ্ট ভুলের ভিতরে”।-সুরা — আহযাব /৩৬ ।


রাসূল (সা.) সাধারণত আনুষ্ঠানিকভাবে কোন সভা আয়োজিত হলে তাতে বিশেষ পাগড়ি পড়তেন যার নাম ছিল ‘সাহাব’। তিনি গাদীরের সমাবেশে তাঁর এ বিশেষ পাগড়ি আলী (আ.)-এর মাথায় পরিয়ে দিলেন। তখন উপস্থিত সকলে হযরত আলীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করলেন। জনতার মধ্যে “মারহাবা মারহাবা ” পড়িয়া গেল।এরপর রাসুলে খোদা (সাঃ) বলেনঃ “ফেরেশতারা ঠিক এরূপে আমার কাছে আসে। এভাবেই গাদীরের ঘটনার সমাপ্তি ঘটলো এবং হাজীরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অঞ্চলের বা দেশের পথ ধরে জাজিরাতুল আরব হতে পরস্পর আলাদা হয়ে গেলেন। তারা বেলায়াত বা কর্তৃত্বের হাদিসটি সমস্ত মুসলমানের কানে পৌঁছে দিয়েছেন।“তিনি গাদিরে খুমে তিন দিন অবস্থান করেছিলেন। এই তিন দিন ধরে শীর্ষস্থানীয় সব সাহাবিগণসহ সব মুসলিম নারী-পুরুষ পৃথকভাবে হযরত আলী (আ.)-কে আমিরুল মুমিনিন হিসেবে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বলে নির্ভরযোগ্য সুন্নি বর্ণনায় এসেছে। রাসুলের আ. আদেশ অনুসারে নব নিযুক্ত নেতার নিকট আসিয়া সকলেই আনুগত্যের বায়াত গ্রহণ করিল।

এই দিনটি ঐতিহাসিক গাদীর দিবস বা ঈদে গাদীর হিসেবে খ্যাত।

আবারও ঈদে গাদির উপলক্ষে সমস্ত আশিকে রাসুল সাঃ ও আহলে বাইত প্রেমিকদের প্রতি অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইল।


এই দিনটি ঐতিহাসিক গাদীর দিবস বা ঈদে গাদীর হিসেবে খ্যাত।

আবারও ঈদে গাদির উপলক্ষে সমস্ত আশিকে রাসুল সাঃ ও আহলে বাইত প্রেমিকদের প্রতি অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইল।


তথ্যসূ্ত্রঃ

এই হাদীসটি বিভিন্ন তাফসীরকারক ও মুফাসসীরগণ তাদের নিজ নিজ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।ইমাম বোখারীসহ ৩৬০ জন সুন্নি মনীষী এ সংক্রান্ত হাদিস বর্ণনা করেছেন।ঐতিহাসিক এ হাদীসটি কমপক্ষে ১১০ জন সাহাবা,৮৪ জন তাবিঈন,৩৫৫ জন ওলামা,২৫ জন ঐতিহাসিক,২৭ জন হাদীস সংগ্রাহক,১১ জন ফিকাহবিদ,১৮ জন ধর্মতাত্ত্বিক ও ৫জন ভাষাতাত্ত্বিক কর্তৃক বর্ণিত হয়ছে। 

গাদীর সম্পর্কিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের তথ্যসূ্ত্রের তন্মধ্য কিছু গ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করা হলঃ- সহিহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ:-৩৬২; সহিহ তিরমিযি, হাদীস নং:-৪০৭৮ / মুসনাদে আহমাদ, ২য় খণ্ড, পৃ:-৪১২; /সুনানে ইবনে মাজা, ১ম খণ্ড, পৃ:-৪৫; /মুসতাদরাকে হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃ:-১১৮; /তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ:-৪৩; /তারিখে তাবারী, ২য় খণ্ড, পৃ:-৪২৯;/সুনানে নাসাই, ৫ম খণ্ড, পৃ:-১৩২; /আল মুসনাদ আল‑জামে, ৩য় খণ্ড, পৃ:-৯২; /আল মুজাম আল‑কাবির, ৪র্থ খণ্ড, পৃ:-১৬;/কানজুল উম্মাল, ১৩ তম খণ্ড, পৃ:-১৬৯; /তারিখে দামেশক, ২য় খণ্ড, পৃ:-৪৫ /সহীহ তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, ২০তম অধ্যায় (বাবু মানাকিবি আলী ইবনে আবি তালিব), পৃ. ৬৩৩, হাদীস নং ৩৭১৩; /সহীহ ইবনে মাজা, ১ম খণ্ড, বাবু ফাজায়িলি আলী ইবনে আবি তালিব, পৃ. ৪৩, হাদীস নং ১১৬ এবং পৃ. ৪৫, হাদীস নং ১২১;/ মুসনাদে আহমাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭২ ও ২৮১;/ মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০৯-১১০; খাসায়িস, নাসায়ী, পৃ. ২২ ও ১২২; /আননিহায়া ফি গারিবিল হাদীস, ইবনে আসীর, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২২৮; /আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর, ১২তম খণ্ড, পৃ. ২১৯; /সাওয়ায়েকে মুহরিকা, ৯ম অধ্যায়, হাদীস নং ৪, পৃ. ১২২; /তারিখুল কাবীর; বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৫ /আহম্মদ-আল‑হাদীস,মেশকাত ৪র্থ খন্ড,পৃ-৫৪৮,ফজলুল করিম;/ মসনদে আহমদ ইবনে হাম্বল,৪র্থ খন্ড,পৃ-২৮১;/তফসীরে কাশশাফ/তফসীরে দোররে মনসুর,আল্লামা জালালুদ্দিন সূয়তী,২য় খন্ড (মিশর)/সহি মুসলিম,২য় খন্ড,পৃ-৩৬২;/মোসতাদারাক হাকীম ‚২য় খন্ড,পৃ .১০৯/গাদীর কুজা আস্ত , পৃষ্ঠা — ৪৩/তাফসীরে দুররে মানসুর , খন্ড — ৩, পৃ- ১১৭ / তাফসীরে কাবির , খন্ড — ১২ , পৃ- ৫০ / তাফসীরে মানারিজ , খন্ড — ২, পৃ-৮৬ / তাফসীরে আলুসি , খন্ড — ২, পৃ- ৩৮৪ / আসবাবুন নুযুল, পৃ- ১৩৫ / শাওয়াহেদুত তানযিল, খন্ড — ১, পৃ- ১৯২ / তারিখে দামেস্ক , খন্ড — ২ , পৃ- ৮৬ / ফাতহুল কাদীর, খন্ড — ২ , পৃ- ৬০ / মাতালেবাস সাউল, খন্ড- ১ , পৃ- ৪৪ / আরজাহুল মাতালেব, পৃ- ১১৯ (উর্দ্দু) / আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া , খন্ড — ৩, পৃ- ২১৩ / মুসনাদে হাম্বল , খন্ড — ৪ , পৃ- ২৪ / তারিখ আল খাতিব, খন্ড — ৮ , পৃ- ২৯০ / কানজুল উম্মাাল, খন্ড — ৬, পৃ- ৩৯৭ / আর রিয়াযুন নাজরা , খন্ড — ২, পৃ- ১৬৯ / মিসকাত আল মাসাবিহ, পৃ- ৫৫৭ / মুসতাদরাক হাকেম, খন্ড — ৩, পৃ- ১০৯ / সিবরুল আলামীন, পৃ- ৯ (ইমাম গাজ্জালী ) / আরজাহুল মাতালেব , পৃ- ৯০৭ — ৯৬৪ / ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাত , পৃ- ১২০ /ঐতিহাসিক আল গাদীর , পৃ- ৫ — ১২৮, মীর রেজা হোসাইন শহীদ / ইসলামী বিশ্বকোষ , খন্ড — ১০ , পৃ- ৩০৭ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) / সহীহ আল বুখারী , খন্ড — ৫ , পৃ- ২৮০ (হামিদীয়া লাইব্রেরী) / সীরাতুন নবী , খন্ড- ২ , পৃ- ৬০৫ (তাজ কোং) / তাফসীরে মাযহারী , খন্ড — ৩ , পৃ- ৭৩৩ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) / সুনানে ইবনে মাজা , খন্ড — ১ , পৃ- ৪৩ , হাদিস নং — ১১৬ / তারিখে ইবনে কাসির , খন্ড — ৪ , পৃ- ২৮১ / মারেফাতে ইমামত ও বেলায়েত , পৃ-৬৪ থেকে ৬৯ ।

গাদিরে খুমের ঘটনাবলীর উল্লেখ রয়েছে এমন কিছু পুস্তকঃ-তফসিরে দুর্বে মনসুর‑জালাল উদ্দিন সিউতি | তফসিরে আল কাশশাফ ওয়াল বায়ান—আবু ইসহাক সায়ালবী | তফসিরে গারায়েবুল করান—আল্লামা নেশাপুরী | উসুলে কাফি—মোহাক্কেক কালিনী | সরহে নাহজুল বালাগা—ইবনে আবি আল হাদিদ মোতাজেলি | মসনদ—ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বাল | সওয়ায়েক্কে মাহরেক্ক—হাফেজ ইবনে হাজার মক্কি | আবাকাতুল আনওয়ার—আল্লামা সৈয়দ | আল গাদির—দানেশ মন্দ মহরম শেখ আব্দুল হোসাইন আহমদ | তারেখে রাসুল অল মুলুক—মোহাম্মদ ইবনে জারির তাবারি | মুরুজ আজজাহাবে—আলী ইবনে হাসান আলী আল্‌ মাসয়দি | এসতাবে অছিয়ত—আলী ইবনে হাসান আলী আল্‌ মাসয়দি | সাজারাতাল জাহাব—ইবনেল এমাদ | তারিখ শায়েরি লে—সাদরুল ইসলাম আবদাল মাসিহ এনতাকি বেগ | আল ফেতনাতুল কুবরা—ডাক্তার তাহা হোসাইন | ঈদে গাদির—বুলেস সালাসা। দি স্পিরিট অব ইসলাম—সৈয়দ আমির আলী | দি শিয়া আইট রিলিজিয়ন—ডোরায়েট এম. ডোনাল্‌ড্‌ সেন| নবীবংশ (পাক পান্জাতন ) পরিচিতি ও মহান কোরবানী-হযরত শাহ সুফি সৈয়দ মোহাম্মদ ইসহাক আল হোসাইনী | আল গাদির (১৮ খন্দ)—সৈয়দ আল আমিনী, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিশর | মাওলার অভিষেক ও ইসলামের মতভেদের কারণ—মাওলা সূফী সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী | ঐতিহাসিক আল- গাদীর,-সংকলন সম্পাদনায় — মীর রেজা হুসাইন শহীদ | ‘ইজালাতুল খাফা’ ‑শাহ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলবীর।

—সৈয়দ হোসাইন উল হক
এম‑ফিল,ইসলামিক স্টাডিজ এন্ড হিস্টোরি,অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি।