ফানা ফিল্লাহ বাকা বিল্লাহ এই শব্দ দুইটি আমরা আমাদের বিভিন্ন আলোচনায় বলে থাকি, যার সহজ বাংলা আল্লাহর সাথে মিলন বললে ভুল হবে না। বস্তুত আমরা এটা বুঝলেও এঁর ধাপ এত সহজ নয়।
হজরত আকদাস গাউছুল আযম খানবাহাদুর আহছান উল্লাহ্ ওয়ার্ছী আঃ তাঁর পাক কেতাব সুফি এঁর মধ্যে খুব সহজ ভাষায় খোদা প্রাপ্তির পথ সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা করেছেন। এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে দয়া করে সুফি বই টি অধ্যায়ন করবেন। তবে এই লেখা সুফি কেতাব থেকে নেয়া হয়নি। তবে সুফি কেতাব অধ্যয়ন এঁর পর লেখা।
সূফীদের মতে, আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক হচ্ছে প্রেমের সম্পর্ক। মানুষ হচ্ছে প্রেমিক আর আল্লাহ হচ্ছেন প্ৰেমাস্পদ । প্ৰেমাস্পদের নিকট পৌঁছতে প্রেমিকের কষ্ট হয় ।
পবিত্র কুরানে বর্ণিত আছে : ‘"আল্লাহ পর্যন্ত পৌছতে মানুষদেরকে কষ্ট স্বীকার করতে হবে । অতঃপর তারা আল্লাহর সাথে মিলিত হতে পারবে ।”
কঠোর সাধনা দ্বারা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সূফী-সাধক ঐশী-জ্ঞান বা মারেফাত অর্জন করে । এরপর আল্লাহর সাথে মিলনের জন্য সে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। তখন মৃত্যু এ মিলনের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় । মৃত্যু হলেই প্রেমিক প্ৰেমাস্পদের সাথে গিয়ে মিলিত হতে পারে । প্ৰেমাস্পদ আল্লাহর হাকীকত উপলব্ধির জন্য সাধককে পাঁচটি মোকাম বা আলমের জ্ঞানার্জন করতে হয় ।
এ আলমগুলো হচ্ছে :
(১) আলম-ই-নাসুত
(২) আলম-ই-মালাকুত
(৩) আলম-ই-জাবারুত
(৪) আলম-ই-লাহুত এবং
(৫) আলম-ই-হাহুত”
(১) আলম-ই-নাসুত
এ পার্থিব জগতকে আলম-ই-নাসুত বলা হয় । আলম-ই-আজসাম বা জড় জগত ও আলম-ই হাইওয়ান বা জীব জগত নিয়ে আলম-ই-নাসুত । এ স্তর সৃষ্টির সর্বনিম্ন স্তর । আল্লাহর আনুগত্যের প্রকৃত পরিচয় এ স্তরে ঘটে। সাধকের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এ জগতের স্বরূপ ও মর্যাদা উপলব্ধি করা আবশ্যক ।
(২) আলম-ই-মালাকুত
এটা সূক্ষ্ম দেহধারী সত্তার জগত । এটা রূহ ও ফেরেশতাদের জগত । একে “আলম-ই-আরওয়াহ’ বলা হয় । তাছাড়া জগতে যত বস্তু রয়েছে তার প্রতিটির সূক্ষ্ম আকার এ জগতে রয়েছে।
এটাকে প্লেটোর “ধারণার জগতের’ সাথে তুলনা করা যায় । সূফী পরিভাষায় একে আলমে মিসাল বলা হয় । সুতরাং আলম-ই- মালাকুত “আলম-ই-আরওয়াহ’ ও ‘আলম-ই-মিসাল’ নিয়ে গঠিত ৷ সাধক যিকির, ফিকির, মুরাকাবা ও মুশাহিদার মাধ্যমে এ স্তরে উপনীত হয় ।
(৩) আলম-ই-জাবারুত
এটা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক জগত । এ স্তরে সাধকের নিকট আল্লাহর গুণাবলি বা সিফাতের হাকীকত পৃথক পৃথকভাবে প্রকাশিত হয় । সে আল্লাহর অসীম শক্তি, গৌরব, ঐশ্বর্য ও মাহাত্য উপলব্ধি করতে পারে। সে আল্লাহর রবুবিয়াত বা প্ৰভূত্বকে বুঝতে পারে । সাথে সাথে সে স্বীয় ক্ষুদ্রত্ব ও সীমাবদ্ধতাকে অনুভব করতে পেরে অধিকতর সাধনায় লিপ্ত হয় ।
(৪) আলম-ই-লাহুত
এ স্তরে সাধকের নিকট আল্লাহর সমষ্টিগত গুণাবলি প্ৰকাশিত হয় । এ স্তরে সাধক জগতের সমস্ত কিছুর মধ্যে আল্লাহর জাত বা সত্তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে । সে নিজেকেও ঐশী অস্তিত্বের মধ্যে নিহিত বা নিমজ্জিত বলে উপলব্ধি করে ।
(৫) আলম-ই-হাহুত
এ স্তরে সাধকের উপলব্ধির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয় । এ স্তরে সাধক স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে উঠে যায় । এখানে সে সৃষ্টি, প্রকৃতি, সিফত বা গুণাবলি সবকিছুর অস্তিত্ব ভুলে যায় । তার উপলব্ধিতে কেবল আল্লাহর একত্ব বা ওয়াহদানিয়াতেই থাকে । এ অবস্থায় সে আল্লাহর সত্তায় স্থিতি লাভ করে । সে আল্লাহময় হয়ে যায় । আল্লাহ তার চিন্তা, ইচ্ছা, অনুভব ও কর্মে রূপান্তরিত হয় । এ অবস্থা সম্পর্কে হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত আছে যে, “যখন আমার বান্দা অতিরিক্ত আমল দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে, তখন আমি তাকে বন্ধু বলে জানি। এ অবস্থায় আমি তার কর্ণ হই, যদ্বারা সে শ্রবণ করে, আমি তাঁর চক্ষু হই, যা দ্বারা সে শ্রবণ করে আমি তার হস্ত হই যদ্বারা সে ধারণ করে এবং আমি তার পদযুগল হই যন্দ্বারা সে চলে ।” এ ধরনের বন্ধু মৃত্যুর পর আল্লাহর সত্তায় মিলিত হয় । এবং শাশ্বত আনন্দ উপভোগ করে ।
আলম-ই-লাহুত ও আলম-ই-হাহুত স্তরে সাধক ‘ফানা” ও “বাকা’ প্ৰাপ্ত হয়। “ফান’ হচ্ছে স্বীয় অস্তিত্ব-বোধকে ভুলে যাওয়া । অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ,আত্মকেন্দ্রিক, গুণ ও কার্যাবলীকে পরিত্যাগ করে আল্লাহর গুণাবলি প্রতিষ্ঠা কলেপ আত্মবোধকে ভুলে যাওয়া হচ্ছে ফানা।
এ প্রসঙ্গে ইমাম গাযালী বলেন :
When the worshipper thinks no longer of his worship or himself, but is altogether absorbed in Him Whom he worships, that state is called fana, when a man has so passed away from himself that he feels nothing of his bodily members, nor of what is passing without, nor of what passes within his own mind."
“বাকা’ হচ্ছে স্থিতি লাভ করা । আল্লাহর সত্তায় স্থিতি লাভ করাকে বাকা বলে অভিহিত করা হয় । ফানা অবস্থায় সাধক সবকিছু ভুলে যায়, স্বীয় অস্তিত্ববোধকেও বিলীন করে দেয়, তখন সাধকের নিকট আল্লাহ ব্যতীত অন্যকিছুর বোধ থাকে না । সে আল্লাহময় হয়ে যায় । তার সকল কিছু জুড়ে কেবলই আল্লাহ । আল্লাহর অস্তিত্বই তার নিকট একমাত্র অস্তিত্ব। আল্লাহর গুণাবলিই তার গুণাবলি, আল্লাহর সত্তাই যেন তার সত্তা । এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে আবার ক্ষণস্থায়ীও হতে পারে । এ অবস্থায়ই বিখ্যাত সূফী মনসুর হাল্লাজ উচ্চারণ করেছেন : ‘আনা আল হক’ – আমিই সত্য বা আমিই আল্লাহ, বায়েজীদ বোস্তামী উচ্চারণ করেছেন, “সমস্ত প্ৰশংসা আমার, আমি কি গৌরবের অধিকারী,” আবু বকর শিবলী উচ্চারণ করেছেন, “এ জগতে আমি ব্যতীত আল্লাহর সত্তায় রূপান্তরিত হয়ে যায় ।
এ সম্পর্কে নিকোলসন একটি চমৎকার মন্তব্য করেন : “He who has attained to this station journeys in the Real, by the Real, to the Real, and he then is a reality .
এ পার্থিব জীবনেই আল্লাহর সত্তায় স্থিতি লাভ সম্ভব হয় । মনসুর হাল্লাজ, বায়েজীদ বোস্তামী প্রমুখ। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ । পার্থিব জীবনে যারা আল্লাহর সত্তায় স্থিতি লাভ করলো বা মিলিত হলো তারা মরণোত্তর জীবনে আল্লাহর সত্তায় মিলিত হবে এটা অসম্ভব নয় বা অযৌক্তিকও নয় । সূফীরা পার্থিব জীবনে আল্লাহর সত্তায় স্থিতি লাভের তুলনায় মরণোত্তর জীবনে আল্লাহর সাথে একীভূত হওয়া বা মিলনকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয় । তারা মরণোত্তর জীবনে জান্নাত লাভের চেয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা বা আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়াকে শ্ৰেষ্ঠ মনে করেন । এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, আল্লাহময় হওয়াতে, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে বা আল্লাহর সাথে মিলনের ফলে ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব লোপ পায় কি-না ? পরমাত্মার মিলনে ব্যক্তিসত্তা ধৃংস হয় না বা তার অস্তিত্বের বিলোপ ঘটে না । আত্মা অমর | পরমাত্ময় গিয়েও ইহা মৃত্যু, বিলোপ ও ধূংসের উর্ধে থাকে । ব্যক্তিসত্তা কেবল নিজেকে শাশ্বত আনন্দের অধিকারী করে, স্বীয় জীৰ্ণতা-শীর্ণতা, ক্ষুদ্রতা ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে পরমাত্মার গুণাবলিকে আত্মীভূত করে ।
আল্লামা ইকবাল বলেন : “ইসলামী সূফীবাদের উচ্চতর স্তরে এই একত্বমূলক অনুভূতি সসীম খুদী নয়, এ খুদী কোনোরূপ শোষণপ্রক্রিয়া মারফত অসীম খুব্দীর মাঝে আপনাকে হারিয়ে ফেলে না ; বরং এ হলো সসীমের প্ৰেমালিঙ্গনে অসীমের ধরা দেওয়া।”
প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে সসীমের অসীমে উত্তরণ । সসীম একরূপ থেকে অন্যরূপে পৌঁছে। এতে অস্তিত্ব বিলীন হয় না । এ হচ্ছে সসীমের চেষ্টা সাধনার বিজয় । কঠোর সাধনার ফলে সে পরমাতন্ত্রায় মিলনের সৌভাগ্য অর্জন করে । তার অস্তিত্ব ধৃংস হলে বিজয়ের স্বাদ গ্রহণের অবকাশ কোথায় ? এ মিলনে সসীম অসীমের মধ্যে অদৃশ্য হয় । বৃহত্তর ব্যাপ্তিতে নিজেকে বিস্তৃত করে।