সিজদাতুন শব্দের অর্থ মাথা জমিনে রাখা, আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে কপালকে ইবাদতের নিয়তে আল্লাহর উদ্দেশ্যে জমিনের উপর রাখা (তাফসীরে কবির, তাফসীরে জালালাইন শরীফ ও ফিকাহে আকবর দ্রষ্টব্য)।
তাজিমি সেজদার সংজ্ঞা ও প্রাকার
ইসলামী পরিভাষায় জমিনে মাথা ঠেকানোকে সেজদা বলে। কারণ ইসলাম ধর্মে নামাজ বা ইবাদতে এটাই সেজদার রূপ।
সেজদা প্রধানত ২ প্রকারঃ
১। সেজদায়ে তাবুদী বা ইবাদতের সিজদা।
২। সেজদায়ে তাহিয়্যাহ বা তাজিমি সেজদা।
ইবাদতের সেজদার কিছু শর্তাবলী আছেঃ
১। সেজদার নিয়ত থাকতে হবে।
২। সেজদায় তছবী জপতে হবে।
৩। ওযু থাকতে হবে।
৪। কিবলামুখী হতে হবে ইত্যাদি।
১নং, ৩নং, ৪নং শর্ত পূরণ হলেই সেজদা পরিপূর্ণতা পাবে। সেই সেজদার মালিক একমাত্র আল্লাহু তায়ালা।
আর তাজিমি সেজদা শুধুমাত্র আল্লাহর খাছ বান্দা তথা নবী, পয়গম্বর, আউলিয়া কেরামের জন্য। এটি তাঁদের সম্মানার্থে প্রদান করা হয় যা দোষণীয় নয়।
কোরানে পাকে সুরা ইউছুফের ১০০নং আয়াতে উল্লেখ আছে, হযরত এয়াকুব আঃ ও তাঁর অন্যান্য পুত্ররা হযরত ইউছুফ আঃ কে সেজদা দিয়েছেন।উল্লেখ্য এই সেজদা তাজিমি সেজদা।
(১) মেশকাত শরীফের ৩৯৬ পৃঃ ৮ম হিঃ সালে বর্ণিত হাদিসে পাওয়া যায়, হযরত আবু খোজায়মা (রঃ) রাসুলে খোদা (দঃ) কে তাজিমী সেজদা করেছেন।
(২) আনিসুল আরওয়াহ কিতাবে বিভিন্ন হাদিস সূত্রে পাওয়া যায় হযরত ওমর (রাঃ), হযরত বেলাল (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), রাসুলে খোদা (দঃ) কে তাজিমি সেজদা করেছেন।
তাজিমি সেজদা যদি হারাম হত হযরত ইউছুফ (আঃ), রাসুলে খোদা (দঃ) তাজিমি সেজদা গ্রহণ করতেন না বরং বাধা বা নিষেধ করতেন, কিন্তু তাঁরা তা গ্রহণ করেছেন।
অতএব, এতেই প্রতীয়মান হয় তাজিমি সেজদার প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তবে হ্যাঁ এটা সম্পূর্ণ যার যার মনোগত ব্যাপার। যার মন চায় সে করতে পারবে, যার মন চাইবে না সে করবে না। এটা করা ফরজ, ওয়াজীব, বা নাজায়েজ নয় বরং মুবাহ।
তাজিমি সেজদা সম্পর্কিত কিছু জবাবঃ
সেজদা মূলত ২ প্রকার।
(১) ইবাদতের উদ্দেশ্যে সেজদা।
(২) তাজিমী সেজদা।
ইবাদতের সেজদা শুধুমাত্র আল্লাহপাকের জন্য নির্ধারিত। আর তাজিমী সেজদা পাঁচ প্রকারের ব্যাক্তির জন্য জায়েজ আছে। (১) উম্মতগন নবীর জন্য। (২) মুরিদগন পীরের জন্য। (৩) প্রজাগন ন্যায়পরায়ন বাদশার জন্য। (৪) সন্তান পিতামাতার জন্য। (৫) গোলাম মুনিবের জন্য।
আর দুপ্রকারের সেজদা আছে তা হলো;
(১) তেলোয়াতের সেজদা। (২) শোকরের সেজদা।
তাজিম সেজদার পক্ষ-বিপক্ষঃ
তাজিমী সেজদা জায়েজ নাজায়েজের ব্যপারে ইসলামিক চিন্তাবিদ গবেষকগন দুই ধারায় বিভক্ত। আলা হযরত শাহ আহমদ রেজা খান বেহেরলভী সহ বহু সংখ্যার তাফসীর কারকগন এর বিরোধী।
উনি উনার “হুরমায়ে তাজিম সেজদা” নামক গ্রন্থে তাজিমী সেজদা হারামের পক্ষে মত দিয়েছেন। অপর পক্ষে মাওলানা রুমি হতে হতে শুরু করে শেরে বাংলা হুজুর সহ বিশিষ্ট তাফসীর কারক মুফতিয়ে আজম আমিনুল হক ফরহাদাবাদী তাজিমী সেজদা জায়েজের পক্ষে মত দিয়েছেন।
মাওলানা ফরহাদাবাদী তার “তোহফাতুল আখইয়ার” গ্রন্থে তাজিমী সেজদা জায়েজের পক্ষে যে সব প্রমানাদি পেশ করেছেন তা অন্য কোন কিতাবকে খন্ডন করার জন্য যথেষ্ট।
তাজিমী সেজদা জায়েজের পক্ষে দলিলঃ
পবিত্র কোরানের আয়াত।
(১) “যখন আমি ফেরেশতাগণকে বললাম আদমকে সেজদা করার জন্য তখন ইবলিশ ব্যতীত সবাই সেজদা করল”।
(২) “ইউসুফ (আ:) তার মাতাপিতাকে উচ্ছাসনে বসালেন এবং তারা সবাই তার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন”।
আয়াত দুটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় উপরোক্ত সেজদাগুলি ছিল সম্মানসূচক সেজদা। কোরানের আয়াত দ্বারা তাজিমী সিজদা জায়েজ বলে প্রমাণিত হয়। কেননা আল্লাহপাক কোরানের প্রতিটি আয়াত তার বান্দাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য নাজিল করেছেন। আল্লাহপাক নিশ্চই তার বান্দাদের শিরকের নির্দেশ দিবেননা। বিরোদিতাকারিরা বলে থাকেন ঘঠনাগুলি আমাদের শরিয়তের নয়। ইয়াকুব(আ:) এর সময়ের শরিয়ত আমাদের শরিয়তের কাছে রহিত হয়ে গেছে। তখন সেজদা জায়েজ ছিল এখন হারাম বা শিরক।
এখন প্রশ্ন; তখন যদি শরিয়তে তাজিমী সেজদা জায়েজ থাকে এখন কিভাবে রহিত হবে। কেননা এক শরিয়তে জায়েজ আরেক শরিয়তে হারাম কখনও হতে পারেনা। বরং ফরজিয়ত বা মোস্তাহাব রদ হলেও বর্তমান যুগে তা মোবাহ বা জায়েজ। কেননা যে সমস্ত কোরানের আয়াত রদ করা হয়েছে তা তফসিরে আহমদীতে বর্ণনা করা হয়েছে কিন্তু তাজিমী সেজদার আয়াত গুলো উখানে নেই। মানে রদ করা ইয়নি।
ইমাম আবু হানিফার কিতাবেও সেজদায়ে তাজিমীর আয়াতগুলো রদ হয়নি। খবর মুলক আয়াত রদ করা যায়না সুতরাং উক্ত আয়াতগুলো তাজিমী সেজদার দলিল হিসাবে অত্যন্ত মজবুতকর।
বিরোধিতাকারীরা যুক্তি হিসাবে এই হাদিসটি সবসময় পেশ করে থাকেন;
রাসুলুল্লাহ (স:) বলেন আমি যদি কাউকে সেজদা করার হুকুম দিতাম তাহলে স্ত্রীলোককে বলতাম তার স্বামীদেরকে সেজদা করার জন্য।
এই হাদিসটি খবরে ওয়াহেদ হাদিস। অর্থাৎ প্রত্যেক যুগে এই হাদিসের বর্ননাকারী একজন। এটি দুর্বল হাদিস। এবং এটি দ্বারা কোরানের আয়াত রদ করা যাবেনা। কোরানের আয়াত রদ করার জন্য হাদিসে মতওয়াতরের প্রয়োজন। আর উক্ত হাদিসটি মূলত স্বামী-স্ত্রীর তাবেদারীর বিষয়ে বলা হয়েছে। সেজদা বিষয়ে নয়। সুতরাং এই হাদিসটি তাজিমী সেজদার বিরুদ্ধে দলিল হিসাবে গ্রহনযোগ্য নয়। আর আমাদের শরিয়তে তাজিমী সেজদা রদের জন্য আর তেমন আর কোন দলিল নেই।
হাদিস শরীফে আছে একদা এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা:) এর নিকট এসে বললো হে খোদার রাসুল আপনি আপনাকে সেজদা করিতে স্বপ্নে দেখিয়াছি। রাসুলুল্লাহ (সা:) বলিলেন তোমার স্বপ্ন সত্য। তখন লোকটি নবী করিম (সা:) কে সেজদা করিল। রাসুলুল্লাহ (সা:) কোন বাধা প্রদান করলেননা। সুতরাং কোরআন হাদিস দ্বারা তাজিমী সেজদা জায়েজ বলেই প্রমানিত হয়।
আর এর বিরুদ্ধে কোরআন হাদিসের কোথাও সরাসরি হারাম বলে ঘোষণা করা হয়নি। অবশ্য কাউকে আল্লাহ জ্ঞান করে সেজদা করলে অবশ্যই শিরক হবে। আর তাজিমী সেজদা হলো মূলত এক প্রকার সালাম। এবং এটা শুধুমাত্র সম্মানের জন্য করা হয়। আর তাজিমী সেজদার দ্বারা পীর মুরশিদকে সম্মান জানানো জায়েজ বলেই প্রমাণিত।
তাজিমী সেজদা জায়েজের পক্ষে যে সমস্ত কিতাবে দলিল পাওয়া যায় তা নিম্নে তুলে ধরা হলো।